বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৪

রক্ত, রক্তের গ্রুপ, আরএইচ ফ্যাক্টর ও সুস্থ সন্তান (সবার পড়া উচিত)

আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই ? আমি ভাল আছি । আমি আজকে আপনাদের যে বিষয়টি শেয়ার করব তা হল আমাদের শীরের একটি উপাদান রক্ত তা সম্পর্কিত কিছু তথ্য ।বেশি কথা না বলে মূল আলোচনায় চলে আসি ।

রক্ত :

রক্ত কি ? প্রশ্নটির উত্তর সাধারণভাবে দিলে বলা যায় শরীরের কোন অংশে কেটে গেলে লাল রঙের যে তরল পদার্থ বের হয়ে আসে তাই রক্ত । ইহা স্বাদে লবণাক্ত, অস্বচ্ছ, ঈষৎ ক্ষারীয় ও আঠালো চটচটে তরল পদার্থ । একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষের দেহে গড়ে ৫ থেকে ৬ লিটার রক্ত থাকে। প্রধানত অস্তিমজ্জায় রক্ত উৎপন্ন হয় ।
রক্তের উপাদান : রক্ত প্রধানত দুটি উপাদান নিয়ে গঠিত ।যথা :
  • ১। রক্তরস বা প্লাজমা
  • ২। রক্ত কণিকা

রক্তরস :

রক্তের হালকা হলুদ বর্ণের তরল অংশকে রক্তরস বা প্লাজমা বলে ।এই রক্তরসে রক্তকণিকা ভাসমান অবস্থায় থাকে ।রক্তরসে পানির পরিমাণ ৯২% । এছাড়াও রক্তরসে গ্লুকোজ, অ্যামাইনো এসিড, ফ্যাটি এসিড, গ্লিসারল, আমিষ (যেমন : অ্যালুবুমিন, ফিব্রিনোজেন), খনিজলবণ, হরমোন, ভিটামিন, ইউরিয়া, এন্টিবডি, অক্সিজেন, কার্বনডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ ।

রক্তকণিকা :

রক্তরসের মধ্যে ছড়ানো বিভিন্ন ধরনের কোষকে রক্তকণিকা বলে । রক্তের ৪৫% হলো রক্তকণিকা । মানুষের রক্তে তিন ধরণের কণিকা থাকে । যথা :
১। লোহিত রক্তকণিকা
২। শ্বেত রক্তকণিকা
৩। অনুচক্রিকা
লোহিত রক্তকণিকা : লোহিত রক্তকণিকা ক্ষুদ্রাকার, দ্বিঅবতল চাকতির মত । এরা নিউক্লয়াসবিহীন । হিমোগ্লোবিনর নামক একপ্রকার রঞ্জক পদার্থ থাকার কারণে কণিকাগুলো লাল দেখায় । দেহে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২০ লক্ষ কণিকা তৈরি হয় । একটি লোহিত কণিকার গড় আয়ু ৪ মাস ।
শ্বেত রক্তকণিকা : শ্বেত রক্ত কণিকা নির্দিষ্ট আকার বিঞীন ও নিউক্লিয়াস যুক্ত । সুস্থ মানব দেহে প্রতি কিউবিক মিলিলিটার রক্তে ৬০০০ থেকে ১১০০০ শ্বেত কণিকা থাকে ।
অনুচক্রিকা : অনুচক্রিকা সবচেয়ে ক্ষুদ্র রক্তকণিকা । এরা গোল, ডিম্বাকার বা বৃত্তের মত এবং গুচ্ছাকারে থাকে । এতে নিউক্লিয়াস থাকে না । এএদের গড় আয়ু ৫ থেকে ১০ দিন ।

রক্তের কাজ :

  • ১। রক্ত সারা দেহে পানি ও তাপের সমতা রক্ষা করে ।
  • ২। লোহিত রক্তকণিকা হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে ফুসফুস থেকে কোষে কোষে অক্সিজেন পরিবহণ করে ।
  • ৩। শ্বেত রক্তকণিকা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায়য় রোগজীবাণু ধ্বংস করে দেহকে সুস্থ রাখে ।
  • ৪। দেহের কোন স্থান কেটে গেলে অনুচক্রিকা সে সস্থানে রক্ত জমাট বাঁধায় । ফলে ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত বন্ধ হয় ।
  • ৫। রক্তরসের মাধ্যমে কার্বন ডাইঅক্সাইড, ইউরিয়া, হজমকৃত খাদ্যবস্তু(যথা : গ্লুকোজ, অ্যামিনো এসিড, ফ্যাটি এসিড, গ্লিসারল), হরমোন ইত্যাদি দেহের বিভিন্ন অংশে পরিবাহিত হয় ।

রক্তের গ্রুপ :

অস্ট্রিয়া বংশোদ্ভূত আমেরিকান বিজ্ঞানি কার্ল লেন্ডস্টেইনার ১৯০১ খ্যীস্টাব্দে মানুষের লোহিত রক্তকণিকায় প্লাজমা মেমব্রেনের বাইরের দিকে এন্টিজেন নামক প্রোটিনের অস্তিত্ব আবিস্কার করেন । এই এন্টিজেন সাধারনত দুই ধরণের হয় যথা : এন্টিজেন এ এবং এন্টিজেন বি ।কোন একজন মানুষের লোহিত রক্তকণিকায় এন্টিজেন এ অথবা এন্টিজেন বি অথবা এন্টিজেন এ ও বি উভয়ই উপস্থিত থাকতে পারে অথবা এন্টিজেন এ ও বি উভয়ই অনুপস্থিত থাকতে পারে । মানুষের লোহিত রক্তকণিকায় এন্টিজেনের উপস্থিতি ও অনুপস্তিতির উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানী তার্ল লেন্ডস্টইনার ১৯০১ ক্রীস্টাব্দে মানুষের রক্তের যে শ্রেনীবিন্যাস করেন তাকে রক্তগ্রুপ বা এবিও রক্তগ্রুপ বলে । এজন্য ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পান ।
মানুষের লোহিত রক্ত কণিকায় যেরূপ এন্টিজেন থাকে তারসাথে সামঞ্জস্য রেখে রক্তরস বা প্লাজমায় এন্টবডি নামক বিশেষ ধরণের প্রোটিন থাকে । মানুষের প্লাজমায় দুই ধরণের এন্টিবডি থাকে, যথা : ১। এন্টিবডি এ ২। এন্টিবডি বি ।
এভাবে এন্টিজেন ও এন্টিবডির উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে সমগ্র মানবজাতির রক্তকর চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয় । যথা : এ, বি, এবি এবং ও ।
যে নির্দিষ্ট ব্যক্তির রক্তে যে এন্টিজেন নেই, শুধু সেই এন্টিবডি সেখানে পাওয়া যাবে । অর্থাৎ এ গ্রুপে এ এন্টিজেন, বি গ্রুপে বি এন্টিজেন এবং এবি গ্রুপে এ ও বি উভয় এন্টিজেন থাকে । ও গ্রুপের রক্তে কোন এন্টিজেন নেই কিন্তু রক্তরসে এ ও বি দুরকম এন্টিবডিই থাকে । প্রতিটি এন্টবডি তার সমগোত্রীয় এন্টিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে রক্তকে জমাট বাঁধায় অর্থাৎ এন্টিবডি এ, ্এন্টিজেন এ এর সাথে এবং এন্টিবডি বি, এন্টিজেন বি এর সাথে বিরূপ বিক্রিয়া ঘটায় । এজন্য রক্ত গ্রহণ ও প্রদানের পূর্বে অবশ্যই রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করতে হয় । চলুন দেখি কে কোন গ্রুপকে রক্ত দিতে পারবে এবং কার কাছ থেকে রক্ত নাতে পারবে :
এ গ্রুপের রক্তের এন্টিবডি বি গ্রুেপর লোহিত কণিকাকে জমিয়ে দেয় । তদ্রূপ বি গ্রুপের রক্তের এন্টিবডি এ গ্রুপের রক্তের লোহিত কণকাকে জমিয়ে দেয় । কিন্তু এবি গ্রুপের রক্তের প্লাজমায় কোন এন্টিবডি না থাকায় অন্য গ্রুপের রক্তকে জমাতে পারে না । এজন্য এবি গ্রুপধারী মানুষ যেকোন গ্রুপের রক্ত গ্রহণ করতে পারে । তাই এবি গ্রুপকে সর্বজনীন গ্রহীতা গ্রুপ বলা হয় ।
আবার ও গ্রুপের রক্তের লোহিত কণিকায় কোন এন্টিজেন না থাকায় অন্য যে কোন গ্রুপের রক্তের সাথে সহজেই মিশতে পারে । তাই ও রক্ত গ্রুপের মানুষ যেকোন গ্রুপধারী মানুষকে রক্ত দিতে পারে । এজন্য ও গ্রুপকে সর্বজনীন দাতা গ্রুপ বলা হয ।
উল্লেখ্য যে, ও গ্রুপ অন্য সকল গ্রুপকে রক্ত দিতে পারে কিন্তু অন্য কোন গ্রুপ থেকে রক্ত গ্রহণ করতে পারে না এবং এবি গ্রুপ অন্য সকল গ্রুপ থেকে রক্ত গ্রহণ করতে পারে কিন্তু অন্য কাউকে রক্ত দিতে পারে না ।

চলুন দেখি রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করার কিছু ছবি :


Rh ফ্যাক্টর : কার্ল লেন্ডস্টেইনার এবং এ. এম উইনার ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে রেসাস বানর এর লোহিত কণিকায় এক ধরণের এন্টিজেন আবিষ্কার করেন । এই এন্টিজেনকে রেসাস এন্টিজেন বা রেসাস ফেক্টর বা Rh ফ্যাক্টর বলে ।পরবর্তীতে মানুষের লোহিত রক্ত কণিকাতেও এদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন । গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে যে প্রায় ৮৫% মানুষের লোহিত রক্ত কণিকায় আর এইচ ফ্যাক্টর বিদ্যমান থাকে ।যেসব মানুষের লোহিত রক্ত কণিকায়্‌ আরএইচ ফ্যাক্টর বিদ্যমান থাকে তাদের রক্তগ্রুপকে আরএইচ পজেটিভ এবং যেসব মানুষের লোহিত রক্ত কণিকায় আরএইচ ফ্যাক্টর অনুপস্থিত থাকে তাদের রক্তগ্রুপকে এরএইচ নেগেটিভ বলা হয় । যেমন : এ পজেটিভ, এ নেগেটিভ, বি পজেটিভ, ও পজেটিভ, এবি নেগেটিভ ইত্যাদি ।প্রধানত দুই ক্ষত্রে আরএইচ ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যেমন :
  • ১। আরএইচ নেগেটিভ রক্তগ্রুপ বিশিষ্ট কোন রোগীর দেহে আরএইচ পজেটিভ গ্রুপের রক্তের সঞ্চারণ ঘটালে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই রোগীর দেহের প্লাজমায় আরএইচ নেগেটিভ এন্টিবডি সৃষ্টি হয় । ঐ রোগী যদি পরবর্তীতে কখনও আরএইচ পজেটিভ গ্রুপের রক্ত গ্রহণ করে তাহলে আরএইচ নেগেটিভ এন্টিবডির প্রভাবে গৃহীত রক্তের লোহিত কণিকাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে । এতে বিভিন্ন অসুবিধাসহ রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে ।অবশ্য গ্রহীতা যদি পরবর্তীতে আরএইচ পজেটিভ গ্রুপের রক্ত গ্রহণ না করে তবে রক্ত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে ।
  • ২। আরএইচ নেগেটিভ রক্তগ্রুপ বিশিষ্ট মহিলার সাথে আরএইচ পজেটিভ রক্তগ্রুপের কোন পুরুষের বিয়ে হলে তাদের সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে আরএইচ ফ্যাক্টর অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে ।জেনেটিকভাবে আরএইচ পজেটিভ অবস্থা আরএইচ নেগেটিভ অবস্থার উপর প্রকট হওয়ায় এই দম্পত্তির প্রথম সন্তান আরএইচ পজেটিভ হবে । এই শিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ে মায়ের রক্তে আরএইচ নেগেটিভ এন্টিবডি সৃষ্টি হবে ।প্রথমবার গর্ভধারণকালে আরএইচ নেগেটিভ এন্টিবডি যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত না হওয়ায় শিশুর কোন ক্ষতি হয় না এবং এই শিশু জীবিত থাকে ।কিন্তু দ্বিতীয় বা পরবর্তী সময়ে আরএইচ পজেটিভ সন্তান ধারণকালে পূর্বে উৎপাদিত মায়ের রক্তের আরএইচ নেগেটিভ এন্টিবডি অমরার মাধ্যমে ভ্রুণে প্রবেশ করে এবং ভ্রুণের লোহিত কণিকাগুলো ধ্বংস করতে থাকে । এতে ভ্রুণ বিনষ্ট হয়, গর্ভপাত ঘটে বা সদ্যজাত শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে।এ অবস্থায় শিশু জীবিত থাকলেও তার দেহে প্রচন্ড রক্তাল্পতা এবং জন্মের পর জন্ডিস রোগ দেখা দেয় ।তাই বিয়ের আগে হবু বর কণের রক্ত পরীক্ষা করে নেয়া উচিত এবং উভয়েরই একই আরএইচ ফ্যাক্টরভুক্ত অর্থাৎ হয় উভয়ই আরএইচ পজেটিভ নয়তো উভয়েরই আরএইচ নেগেটিভ দম্পতি হওয়া উচিত ।
পরিশেষে বলা যায় রক্ত দান বা গ্রহণ করার সময় শুধু রক্তের গ্রুপই নয় রক্তের আরএইচ ফ্যাক্টর নির্ণয় এবং রক্তে জীবাণুর উপস্থিতি সম্বন্ধেও পরীক্ষা করা উচিত । জরুরী রক্ত গ্রহণ বা দানের দরকার হলে দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ জানা না থাকলে ও এবং আরএইচ নেগেটিভ রক্ত গ্রহণ বা দান করাই উত্তম।

কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ                    ফেসবুকে আমি
Flying Twitter Bird Widget By blogermohsin.blogspot.com