শুক্রবার, ৭ মার্চ, ২০১৪

পিরিয়ডে ব্যথার নিরাময়

আসসালামু আলাইকুম
কেমন আছেন সবাই আশা করি ভাল আছেন, আমিও আপনাদের দোয়ায় আল্লাহর রহমতে ভাল আছি
সারা বিশ্ব জুড়েই ঘরে ঘরে মেয়েদের একটি সাধারণ সমস্যা হল ঋতুস্রাবের সমস্যা যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়। আমাদের দেশে অধিকাংশ মহিলাই নিয়মিত Health Check up বা Screening –র মধ্যে দিয়ে যান না। তাই তলে তলে সমস্যা বেড়ে জটিল আকার ধারণ করে।

ঋতুস্রাব মহিলাদের জীবনে একটি স্বাভাবিক ঘটনা যা প্রতিমাসেই একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর ঘটে থাকে।
ঋতুস্রাবের সমস্যায় অত্যধিক বা অত্যল্প, নিয়মিত বা অনিয়মিত ব্লিডিং আপনার জীবনকে যেমন করে তুলতে পারে তিতিবিরক্ত, অস্বস্তিকর এবং কর্মবিমুখ, তেমনই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যথার ক্ষেত্রেও প্রশ্ন এসে পরে আপনার কাতরতার পরিমাণের।

ব্যথার বিষয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা নির্ভর করে আপনি যন্ত্রণায় কতটা কাতর হচ্ছেন, আপনার জীবন কতটা দুর্বিষহ হচ্ছে তার ওপর। বাচ্চা মেয়েদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যথা সন্তানধারণের পরে এবং দেহের উপযুক্ত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়। মুশকিল হল যদি ব্যথাটা পিরিয়ডের পরেও থেকেই যায়। তখন আর শুধু ওষুধের ওপরে ভরসা না করে ভাবতে হবে এন্ডোমেট্রিওসিস, তলপেটের বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন, ইউটেরাইন এবং সারভাইকাল পলিপ, ডিজেনারেটেড ফাইব্রয়েড-এর কথা। আজকে আমাদের আলোচনা শুধু এই ব্যথার সমস্যাটিকে নিয়েই। বিশেষত অসুখটি যদি হয় এন্ডোমেট্রিওসিস।

উপসর্গ
ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড শুরু হওয়া থেকে মেনোপজ বা পিরিয়ড বন্ধ হওয়া পর্যন্ত যে কোনও সময়ই এই এন্ডোমেট্রিওসিস-এর সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত যে যে উপসর্গগুলি এই রোগটির ক্ষেত্রে দেখা যায় তা হল খুব যন্ত্রণাদায়ক পিরিয়ড, সঙ্গমের সময় ব্যথা, পিরিয়ড শুরুর আগে, পিরিয়ডের সময় এমনকী পিরিয়ডের পরেও তলপেটে ব্যথা, কোমরের তলার দিকে ব্যথা, পেলভিক পেন, এমনকী সন্তান ধারণেও সমস্যা। আর এটাও জেনে রাখা প্রয়োজন যে ভিন্ন ভিন্ন মহিলার ক্ষেত্রে এই রোগের উপসর্গগুলি বিভিন্ন।
 
কারণ ও কোথায় দেখা যায়
এন্ডোমেট্রিওসিস-এর কারণের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। তবে ওভারিয়ান হরমোন এই রোগটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জরায়ুর ভেতরের যে লাইনিং বা এন্ডোমেট্রিয়াম যখন জরায়ুর বাইরে পেরিটোনিয়ামের কোনও অংশে পাওয়া যায় তখনই তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলে। এমনকী শরীরের অন্য অংশে যেমন ফুসফুসেও এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে। তবে সাধারণত ওভারি, ফেলোপিয়ান টিউব, জরায়ুর যে কোনও উপরে বা আশপাশে এন্ডোমেট্রিওসিস দেখা যায়।

এন্ডোমেট্রিওসিস-এর নির্ধারণ বা ডায়াগনসিস
এন্ডোমেট্রিওসিস-এর চিকিৎসার আগে এন্ডোমেট্রিওসিস-এর নির্ধারণ বা ডায়াগনসিস সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্ধারণটি একরকম চ্যালেঞ্জ। কেননা এন্ডোমেট্রিওসিস-এর নির্ধারণ যত দেরিতে হয় ততই রোগটির জটিলতা বাড়তে থাকে সেকেন্ডারি কমপ্লিকেশন, যেমন- টিউব, ওভারি, পায়খানার রাস্তায় অ্যাডহেসন হতে পারে, টিউব ব্লকড হয়ে যেতে পারে। এমনকী সন্তান ধারণ করার জন্য IVF ছাড়া কোনও পথ থাকে না। এমনকী ব্যথা এত বাড়ে যে জীবনধারণের আনন্দই নষ্ট হয়ে যায়। আর অ্যাডহেসন একবার হয়ে গেলে সেটা বারে বারেই হতে পারে। কিন্তু প্রথম দিকে ডায়াগনসিস হলে এই কমপ্লিকেশনগুলি তৈরি হয় না। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে অনেক সময় এন্ডোমেট্রিওসিস নির্ণীত হয় (এন্ডোমেট্রিওমা তৈরি হলে)। তবে নিশ্চিতভাবে ডায়াগনস্টিক ল্যাপারোস্কোপি-এর সাহায্যে ১০০ ভাগ সফলভাবে নির্ণয় করা সম্ভব।

চিকিৎসা
চিকিৎসা মূলত মেডিসিনাল এবং সার্জারি। মেডিসিনাল ট্রিটমেন্টের উদ্দেশ্য হল মহিলাদের নিয়মিত হরমোনের ওঠাপড়া কমিয়ে দেওয়া। এতে গর্ভধারণ সম্ভব হয় না। চল্লিশোর্ধ মহিলাদের ক্ষেত্রে যাঁদের একটু ব্যথা আছে, সন্তান হয়ে গেছে তাঁদের জন্য ব্যথা কমানোর ওষুধ দিয়ে মেনোপজের জন্য অপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। আর যাঁদের বয়স কম তাঁদের ক্ষেত্রে দুই ধরনের ট্রিটমেন্ট হয়। যাঁরা অবিবাহিত বা গর্ভধারণ চাইছেন না বা যাঁদের সন্তান হয়ে গেছে তাঁদের ক্ষেত্রে মেডিসিনাল ট্রিটমেন্ট হল হরমোন থেরাপি। এই সব ক্ষেত্রে প্রোজেস্টেরন এবং FSH হরমোন দুটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে ব্লিডিং বন্ধ হয়ে যায়। আর যাঁরা গর্ভধারণ চাইছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে সার্জারি শ্রেয়। ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করা যেতে পারে। বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে যদি ব্যথা অসহ্য হয় তবে হিস্টেরেকটমি বা জরায়ু বাদ দেওয়া এবং ওভারিও বাদ দেওয়া যুক্তিযুক্ত।
 
শেষ কথা
অনেক মহিলাই নিজের শরীর নিয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে চান না আবার অপারেশন করতেও ইতস্তত করেন। নিজের বা কাছের কারও অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, অপারেশন করার পরবর্তী যন্ত্রণা, অপারেশন পরবর্তী জ্ঞান ফিরে আসার জন্য অসহায়তা, অপারেশন করার পরে কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিশ্রাম নেওয়া এবং ক্ষত সংক্রমণ-এর কথা। এসব কারণেই বহু মহিলাই নীরবে ঋতুস্রাবের সমস্যাকে সহ্য করে যান।

আসল কথা, পিরিয়ড সমস্যার ব্যাপারে ছক-বাঁধা কোনও চিকিৎসার চেয়ে প্রয়োজনীয় হল মহিলাটির সামগ্রিক চিকিৎসা। অনেক ক্ষেত্রেই রক্ত বন্ধ করার বা ব্যথা কমানোর সাধারণ ওষুধেই একজন মহিলার জীবনের রং পাল্টে যেতে পারে, কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় হরমোনাল চিকিৎসা আর খুব অল্প ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পরে কোনও অপারেশনের। আর একান্তই যদি অপারেশন এড়াতে না পারেন তাহলে অন্তত অপারেশনজনিত অসুস্থতাকে এড়ান। আপনার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুর কাছে আপনার যা চাওয়ার তা হল এমন একটি আশ্বাস যে আপনার এই পিরিয়ড সমস্যা কোনও গভীরতর রোগের পূর্বাভাস নয় এবং হয়তো সামান্য চিকিৎসাতেই আপনি ফিরে পাবেন আপনার মনের শান্তি।

ডা. পল্লব গঙ্গোপাধ্যায়
গাইনোকলজিস্ট ও মিনিমালি ইনভেসিভ
পেলভিকফ্লোর সার্জেন
এমআরসিওজি (লন্ডন)
Flying Twitter Bird Widget By blogermohsin.blogspot.com